প্রবাসে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের ওপর যেভাবে চলছে চরম নির্যাতন ও নিপীড়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:০২:৪৭,অপরাহ্ন ২০ ডিসেম্বর ২০১৪
প্রবাস ডেস্ক:: গতানুগতিকভাবে প্রায়শই পত্র পত্রিকায় এমন কিছু সংবাদ, সংবাদ প্রতিবেদন, কলাম, ফিচার ও প্রবন্ধ চোখে পড়ে যা শিহরিয়ে উঠতে হয়। এ দিনের সংবাদ প্রতিবেদনটিও গা শিহরিয়ে উঠার মানবী পাচারের মতো লোমহর্ষক অমানবিক ও মর্মস্পর্শী ঘটনা। যা যে কোন বর্ণ, গোত্র, ধর্ম ও রক্ত মাংসের মানুষই হোক তা সহ্য করার মতো নয়। আর যাদের কোন বোন, মা, স্ত্রী, পুত্র, পরিজন, আত্মীয়-স্বজন দুপয়সা কামাই রোজগার করার জন্যে বিভোই বিদেশে রয়েছে, বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে তাদের কাছে এ সংবাদটি বিষাদে ভরা ও বেদনা বিদোর, আতংকিত ও লোমহর্ষক। তদোপরি এ জ্বালা যন্ত্রণাতো তাদের কাছে কোন অবস্থাতেই নিবৃত্ত হওয়ার কথা নয়। এ দেশের সহজ সরল মানুষকে চাকর, চাকরানী ও গৃহকর্মী থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন দেশে আরো কিছু পেশায় চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে বাড়ি-ঘর, স্থাবর-অস্থাবর, সহায়-সম্বল সব কিছু বিক্রি করে নির্লজ্জ, পাষন্ড, নপুংশ আদম ব্যবসায়ীরা কিভাবে তাদের বিদেশে পাচার করে মানসম্মান, ইজ্জত, সম্ভ্রম নষ্ট করা থেকে শুরু করে দিকভ্রান্ত, দেউলিয়া ও পাগল করে ছাড়ে এমন ঘটনার অন্ত নেই।
এমনিভাবে লেবানন, দুবাই, জর্ডান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহ পরিচারিকার কাজের জন্য প্রেরণকৃত অসহায় সহজ সরল নারীদের উপর অবর্ননীয় পাষন্ড, দুর্বীনিত পশুরা হায়নার মতো তাদের মান-সম্মান, সম্ভ্রম লুন্ঠন করে নেয়। মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন, পত্রিকা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, চাকরির আশায় সহায় সম্বল সব বিক্রীসহ স্বামীর কাজের টাকা আদম ব্যবসায়ীকে দিয়ে লেবাননে যায় জনৈকা হাসিনা নামের অভাবী মহিলা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই লেবানন থেকে ফোন করে হাসিনা তার স্বামীকে বলে, যদি আমাকে লেবানন থেকে ফিরিয়ে না নিয়ে যাও, তাহলে আমি আত্মহত্যা করবো। ওরা আমাকে খুবই নির্যাতন করছে। আমাকে দিয়ে আজেবাজে কাজ করাচ্ছে। তুমি স্বামী হয়ে এ ভয়ানক নির্যাতন থেকে আমাকে উদ্ধার করে আন। তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বাঁচাও। ধার করে টাকা যোগাড় করে আমাকে নিয়ে যাও। দেশে এসে আমার কিডনি বিক্রি করে ধার শোধ করব। প্রায় ২২ দিন পূর্বে মোবাইল ফোনে এভাবেই নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে স্বামী মমিনুরের কাছে করুণ আকুতি জানিয়েছে হাসিনা। বিভিন্ন সূত্র ও পত্রিকাতে এসব কিছু জানায় হাসিনার স্বামী মমিনুর। তার কাছ থেকে আরো জানা যায়, স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে ধার দেনা করে এক ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়েছে ৭০ হাজার টাকা। এই এজেন্সির মাধ্যমেই মমিনুরের স্ত্রী লেবানন গিয়েছিল। দিনমজুর মমিনুরের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তার স্ত্রী হাসিনা সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরাতে সরকারীভাবে ২০১৩ সনের ২৯ এপ্রিল গৃহকর্মী হিসেবে সুদুর লেবাননে পাড়ি জমিয়েছিল। হাসিনার মতো একই পরিণতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের জানা অজানা শত শত হাসিনা, আলেয়া, মনোয়ারা ও সখিনারা। লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া এসব নারীদর উপর চালানো হচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। বাধ্য করা হচ্ছে যৌন ব্যবসায়। যৌন নির্যাতনে কয়েকজন নারী বাংলাদেশে ফিরে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। তাছাড়া এসব দেশে যাওয়া নারীদের উপর পাশবিক ও অকত্য নারী নির্যাতনের কাহিনী অহরহ দেশী বিদেশী পত্র পত্রিকা, মানবাধিকার সংস্থা এবং দেশী বিদেশী সচিত্র জার্নালেও এসব কিছুর বর্ণনা প্রায়শই ছাপা হয়ে থাকে। যাক, ধার-দেনা করে হাসিনার স্বামী মেসার্স বাংলাদেশ এক্সপোর্ট কর্পোরেশন আর এল ৮০৩ এর মালিক বাশারকে টাকা দিলেও এ লেখার সময় পর্যন্ত হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়নি। ১০/১২ দিন দুবাই থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসে আছমা নামের এক নারী।
গৃহকর্মী আছমা টেলিফোনে বর্ণনা দেয় তার উপর পাশবিক নির্যাতনের। দুবাই এয়ারপোর্টে নামার পর এক ম্যাডাম ও এক স্যার আমাদের ৭/৮ জনকে এক অফিসে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে রাতে আরেক ম্যাডাম ও স্যার তিনতলার একটি বাসায় নিয়ে যান। ওই বাসার একটি ঘরে রাখা হয় আমাকে। কিছুক্ষণ পর একজন পুরুষ আমার ঘরে ঢুকে। এরপর আরা তিনজন পুরুষ একে একে আমার ঘরে ঢুকে পশুর মতো আচরণ করে। ওদের হাতে পায়ে ধরেছি, কিন্তু আমাকে ওরা রেহাই দেয়নি। এমনি নির্যাতনের মধ্যেই কেটে যায় পাঁচ দিন। অনেক কান্নাকাটির পর পাঁচ দিনের মাথায় ওই আগের অফিসে রেখে যায় তারা। এরপর আমার কান্নাকাটিতে অবশেষে দেশে ফিরে আসলে হাবিয়া দোযখ ও নরকের কথা জানে আমার লোকজন।
সূত্রে আরো জানা যায়, রাজধানীর পল্লবীর কামরুন্নাহার নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৩ সনের ৭ নভেম্বর জর্ডান থেকে ফিরে আসে। সে গৃহকর্মীর কাজের জন্য গত বছরের জুলাইয়ে জর্ডানে যায়। কিন্তু তাকে গৃহকর্মীর কাজ না দিয়ে নির্যাতন করা হতো। সেখানে তাকে কাজ না দিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়েছে বলে তার বাবা অভিযোগ করেন।
কেরানীগঞ্জের পারুল ২০১৩ সনের মে মাসে গৃহকর্মীর কাজের নামে জর্ডানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। সম্প্রতি সেও দেশে ফিরেছে, এমনিভাবে ঝালকাঠির হাবিবা গত বছর বাসায় কাজ করার জন্য দুবাই গিয়ে প্রচন্ডভাবে শারীরিক নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে এসেছে। দুবাইয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার কুষ্টিয়ার মর্জিনা বেগম নামে এক গৃহবধু, রাজধানীর ফকিরাপুলের মিনার এয়ার ট্রাভেলসের মালিক আনোয়ারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গত ৩ জুলাই আদালতে পিটিশন মামলা করে। মামলাটি সরাসরি গ্রহনের জন্য পল্টন থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মানব পাচার ও দমন আইন, ২০১২ এর ৩ (১) ক, খ, গ, ৭, ৮ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে মামলাটি করা হয়। এজাহারে অভিযোগ করা হয়, আসামী মিনার এয়ার ট্রাভেলসের মালিক আনোয়ার হোসেন, শহীদ হোসেন, সাইফুল, মোতালেব হোসেন, সাঈদ হোসেন ও শেখ নিজামুল কবির সংঘবদ্ধ মানব পাচার দলের সদস্য। ৪৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে এয়ার পোর্টের ক্লিনারের কাজ দেয়ার কথা বলে মর্জিনাকে ৯ জুন ও তার খালাতো বোন রাজিয়াকে ৩০ মে মিনার ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আনোয়ার হোসেন দুবাই পাঠান। এজন্য দুজনের কাছ থেকে ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন আনোয়ার হোসেন। দুবাইয়ের সারজা বিমান বন্দরে পৌঁছার পর সাইফুল হোসেন নামে এককালীন (৪ নং আসামী) মর্জিনাকে রিসিভ করে অফিসে নিয়ে যায়। এরপর নাইজেরিয়ান এক নারীর কাছে বাংলাদেশী ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রী করে দেয়া হয় মর্জিনাকে। ওই নাইজেরিয়ান নারী মর্জিনাকে একটি বাসায় নিয়ে যৌন ব্যবসা করতে বাধ্য করায়। একাধিক নাইজেরিয়ান তাকে যৌন হয়রানী করেছে বলেও সূত্রের অভিযোগে জানা যায়। প্রতিবাদ করলে নাইজেরিয়ান দালাল নারী মর্জিনাকে বলতেন, এই ব্যবসা করানোর জন্যই টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে। ২৫ জুন পর্যন্ত প্রতিদিন অন্ততঃ ৮ জন তার উপর নির্যাতন চালাতো। সূত্রে আরো জানা যায়, এই অবস্থায় সে ০০৯৭১৫০৪৮৯০৭২৯ নম্বর থেকে ১১ জুন স্বামী কবিরকে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে দুবাই থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কান্নাকাটি করে। কবির ১৪ জুন পল্টন থানায় মিনার ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে, পুলিশের চাপে মর্জিনাকে সেখান থেকে ২৭ জুন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তাকে ২৮ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা হয়। মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে সে সেক্সুয়েল অ্যাসাল্ট।
আরো জানা যায়, মর্জিনা ফিরে আসলেও তার খালাতো বোন রাজিয়ার খোঁজ নিতে পারছে না। তাকেও এমনিভাবেই দুবাইয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। মর্জিনা আরো বলেছে দুবাইয়ের ওই বাসায় বাংলাদেশী দুই নারীসহ অপর পাঁচজন নারীকে একই ব্যবসা করতে দেখেছে। বাংলাদেশী দুই নারী মিরপুরের পাখি ও নরসিংদীর রিজিয়া দেশে ফেরার জন্য কাকুতি মিনতি করেছিল তাকে (মর্জিনাকে)।
বিএমইটির ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সনে বাংলাদেশ থেকে ৫৬ হাজার ৪০০ নারী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গেছে ৩৬ হাজার ৭৫ জন নারীকর্মী। এদের অধিকাংশই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে অভিযোগে জানা যায়, নির্যাতনের শিকার বেশীর ভাগ নারীকর্মী সামাজিক কারণে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচারের বিষয়টি চেপে যায়। আবার অনেকে ঘটনার শিকার হওয়ার পর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে নীরবে সহ্য করে অমানবিক সব পশুসুলভ নির্যাতন।
এসব কিছু থেকে প্রশ্ন একটাই, এসব কিছুর পরিত্রান ও দেখার কি আসলেই কেউ নেই? দয়া কর প্রভু হে তুমিই রহমান ও রাহমী, তুমিই রাব্বুল আল আমীন।