প্রকৌশলীকে ঘুষি মারলেন এমপি!
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৩২:৩২,অপরাহ্ন ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪
নিউজ ডেস্ক::
বরগুনা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ থেকে অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের কক্ষে যাচ্ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মালেক। ওই সময় সেখানে উপস্থিত হন বরগুনা-১ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তিনি আকস্মিক চড়াও হন নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপর। একপর্যায়ে প্রকৌশলী মালেকের জামার কলার ধরে কিল-ঘুষি মারতে মারতে উত্তেজিত হয়ে
এমপি বলতে থাকেন, ‘লাঠি কোথায়? ওকে (মালেক) লাঠিপেটা করব।’ রবিবার দুপুরের দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার আকস্মিকতায় সেখানে উপস্থিত জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হতভম্ব হয়ে যান। লাঞ্ছিত প্রকৌশলী ও উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ঘটনা জানা গেছে।
আগের দিন এ ঘটনা ঘটলেও তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি চেপে যান প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু লাঞ্ছিত নির্বাহী প্রকৌশলী সংবাদ মাধ্যমের কাছে ঘটনা ফাঁস করে দেওয়ায় গতকাল সোমবার তা জানাজানি হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগের দিন বিষয়টি অস্বীকার করলেও গতকাল তাঁরাও পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন সাংবাদিকদের কাছে। তবে লাঞ্ছিত নির্বাহী প্রকৌশলী ছাড়া অন্য কর্মকর্তারা তাঁদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমপি প্রতিনিয়তই কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।
অন্যদিকে এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু মারধর করার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের গাছ কাটার জন্য তাঁকে (নির্বাহী প্রকৌশলী) বকাঝকা করেছি।’
প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা জানান, বরগুনা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স উপলক্ষে গত রবিবার দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আগাম মহড়ার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও জেলার অন্য সরকারি-বেসরকারি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ থেকে অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের কক্ষে যাচ্ছিলেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মালেক। ওই সময় এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু সেখানে উপস্থিত হয়ে আকস্মিক চড়াও হন ওই প্রকেৌশলীর ওপর। তখন নির্বাহী প্রকৌশলীর পাশেই ছিলেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা হতভম্ব হয়ে যান। এরপর জেলা প্রশাসকের কক্ষে ঢোকেন এমপি এবং ভিডিও কনফারেন্সের মহড়ায় যোগ দেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মালেক বলেন, ‘আমতলী উপজেলার সুবন্ধি বাঁধের গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চেয়ে রবিবার সকালে সংসদ সদস্য আমাকে ফোন করেন। আমি তাঁকে বলি, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই, জেনে আপনাকে জানাচ্ছি’। এর ১৫ মিনিট পর আবার ফোন করে তিনি জানতে চান। তখন আমি তাঁকে বলি, ‘স্যার ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়েছি খবর পেলে আপনাকে জানাব’। এরপর ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ফোন রেখে দেন। পরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গেলে তিনি আমাকে মারধর করেন। জেলা প্রশাসক, এসপিসহ অনেক কর্মকর্তার সামনে এই ঘটনা ঘটছে।’
আবদুল মালেক আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাঁধ সংস্কারের জন্য গাছ কেটেছে- এ জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ মামলা করতে পারে। ওই ঘটনার জন্য এমপি সাহেব আমাকে মারবেন, এটা তো হতে পারে না। ইস্যুটা হচ্ছে বরগুনা জেলায় সোয়া ২০০ কোটি টাকার কাজ হচ্ছে, এটার একটা হিস্যা তিনি পাবেন না?’
এসপি বলেন, ঝামেলা হয়েছে : পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবার দুপুরে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স উপলক্ষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আগাম মহড়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমিও উপস্থিত হই। একপর্যায়ে সম্মেলন কক্ষ থেকে কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসকের কক্ষে যাচ্ছিলেন। সেখানে সংসদ সদস্য উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলীর ঝামেলা হয়েছে। সেখানে জেলা প্রশাসক উপস্থিত ছিলেন। তবে আমি পেছনের দিকে ছিলাম। তাই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারিনি। প্রকেৌশলীর সঙ্গে সোমবার আমার কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি সাধারণ ডায়েরি করার কথা বলেছেন।’
সূত্রপাত ঠিকাদারি নিয়ে : বরগুনা পাউবো সূত্রে জানা যায়, সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার চার উপজেলায় একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। চার উপজেলার ১৪৬ কিলোমিটার বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামো মেরামতের জন্য এ প্রকল্পে বরাদ্দ আছে ২৩৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় বরগুনার আমতলী, তালতলী ও সদর উপজেলা এবং পটুয়াখালীর রাঙাবালী উপজেলার চরকাজল ও চরবিশ্বাসে পাউবোর সাতটি পোল্ডারে ১৪৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ৪৩টি স্লুইসগেট মেরামত, ৪২টি কালভার্ট ও ১৭টি দুই কপাটের নতুন স্লুইসগেট নির্মাণ এবং পাঁচ কিলোমিটার নদীর তীর বাঁধাই করা হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাউবো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দুই বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ পায় যৌথভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয়া এবং বাংলাদেশের এমইবিএল নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, এমপি ও তাঁর দলের কয়েকজন ঠিকাদার এই কাজ পাওয়ার জন্য তদবির করেও ব্যর্থ হন। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে রবিবার মুঠোফোনে প্রকৌশলীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। শেষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনেই প্রকৌশলীকে মারধর করেন এমপি।
গাছ কাটা নিয়েও বিরোধ : বরগুনার আমতলী উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামতের নামে সম্প্রতি শত শত গাছ কাটার অভিযোগ ওঠে সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ২০০১-২০০২ সালের দিকে সমিতি গঠনের মাধ্যমে ১০ হাজার ফলদ ও কাঠের গাছ রোপণ করে স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, তাদের না জানিয়েই গাছগুলো কেটে ফেলছে পাউবো ও বন বিভাগ। স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে গাছ কাটা বন্ধ হয়।
দফাদার ব্রিজ এলাকার উপকারভোগী সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, দফাদার ব্রিজ থেকে সুবন্ধি বাঁধ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় কয়েক শ গাছ কাটা হয়েছে। কাটা গাছের মধ্যে রেইন্ট্রি, বাবলা ছাড়াও নারিকেলসহ ফলদ গাছ রয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল হাই সেলিম তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই গাছগুলো কাটছেন। কিন্তু গাছ লাগানোর সময় তাদের বলা হয়েছিল, ২০ বছর পর কাটা হবে। ওই গাছ বিক্রি করে একটি অংশ উপকারভোগীদের মধ্যে দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘গত রবিবার সকালে পরিদর্শন করে গাছ কাটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছি। কারণ পাউবো ও বন বিভাগ অবৈধভাবে কোনো দরপত্র আহ্বান ছাড়াই সবুজ বষ্টেনীর শত শত গাছ কেটে ফেলেছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমরা ঠিকাদারকে গাছ কাটার নির্দেশ দেইনি। গাছ কাটলে বন বিভাগ ব্যবস্থা নেবে। গাছকাটার সঙ্গে পাউবোর কোনো সম্পর্ক নেই।’
অন্যদিকে বন বিভাগের পটুয়াখালী বিভাগের কর্মকর্তা মিহির কুমার দে বলেন, ‘পাউবো কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই গাছ কেটেছে। আমরা সেই কাটা গাছগুলো সংরক্ষণ করছি। উপকারভোগীরা ভাবছেন আমরা গাছ কাটছি।’
ডিসি বলেন, গাছ কাটা নিয়ে ঝামেলা : জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল হক বলেন, গাছ কাটা বন্ধ রয়েছে। তবে গাছ কাটা নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে সংসদ সদস্যের ঝামেলা হয়েছে।
‘রাগারাগি করেছি মারধর করিনি’ : এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, ‘নির্বাহী প্রকেৌশলী ঠিকাদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার বাঁধের সবুজ বেষ্টনীর গাছ কেটে ফেলেছেন, যার আর্থিক মূল্য ১০০ কোটি টাকা। আমি এ জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করেছি, মারধর করিনি।’6