দিনদুপুরে পীর ছিনতাইয়ের নেপথ্যে
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩২:৩৭,অপরাহ্ন ১০ ডিসেম্বর ২০১৪
নিউজ ডেস্ক::
দিনদুপুরে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অস্ত্রের মুখে ছিনতাই হলো নূরে বাবা ওরফে চেংড়া মামা ওরফে পাগলা মামা নামে একজন মারজুক আধ্যাত্মিক পীর।
খানকা শরিফ তৈরি, সরকারি জমি দখল এবং অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর উদ্দেশ্যেই এই পীরকে ছিনতাই করা হয় বলে জানিয়েছেন তার মুরিদরা।
প্রায় দশ বছর আগের কথা। মালিবাগ মোড়, শান্তিবাগ বাজার, শান্তিবাগের গলিতে ঢুকতে স্বপ্ন স্টোরের গলিপথের মোড়ে, মসজিদের সামনে ন্যাংটি পরে উদোম গায়ে বসে থাকতেন একজন লম্বা কালো শীর্ণকায় মানুষ। মুখে তিনি কোনো কথা তখনো বলেন না, এখনো বলেন না। শুধু একটার পর একটা বিড়ি টানতে থাকেন। এরই মধ্যে শত শত গরিব, দুস্থ এবং ছিন্নমূল মানুষের নজর কাড়েন নূরে বাবা। যাদের টাকাপয়সা খরচ করে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই, বিপদে-আপদে তারাই নূরে বাবার পায়ের ধুলো নিয়ে জীবন ধন্য করেছেন। ভালো হয়েছেন অসুখবিসুখ থেকে।
নূরে বাবার মুরিদ শহীদ জানিয়েছেন, এই এলাকায় বাবা প্রায় ৪০ বছর ধরে আছেন। এখন অশীতিপর বৃদ্ধ। তারাই তাকে নিয়ে আসেন গুলবাগ রেলগেটে। রেলের জায়গায় ছাপরা তুলে বাবাকে থাকার জায়গা করে দেন। বাড়তে থাকে মুরিদের সংখ্যা। প্রতিদিন শত শত মানুষ আসতে থাকে এই আখড়ায়। শুধু রিকশাচালক, দিনমজুর বা খেটে খাওয়া মানুষই নয়, এখানে আসেন বড় বড় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং সমাজের অনেক নামিদামি মানুষও।
কারা কেন করল ছিনতাই?
গুলবাগ রেলগেটে নূরে বাবার আখড়ায় শত শত মানুষের ভিড় দেখে ওই এলাকার শ্রমিক শ্রেণির একটি মাইজভান্ডারি গ্রুপ তাদের স্বার্থ হাসিলে উঠেপড়ে লাগে। তারা নূরে বাবার আখড়া বর্ধিত করে একটা খুপরি তৈরি করেন। নাসির, নান্টু সেলিম, জামালসহ একটি প্রভাবশালী চক্র দখলে নেয় নূরে বাবার আখড়া। এখানেই সন্ধ্যায় জমিয়ে তোলে মাইজভান্ডারি গানের আসর। গভীর রাত পর্যন্ত চলে তবারক-শিরনি বিতরণসহ নানা ধরনের মজমা।
পাগলা মামার আস্তানার পাশেই মাইজভান্ডারির আস্তানা
এই দখলবাজির মধ্যেই গত নভেম্বরে রেল কর্তৃপক্ষ অবৈধ দখল উচ্ছেদের সময় নূরে বাবার আখড়াটাও ভেঙে দেয়। একেবারে সাধারণ মুরিদরা তখন বাবাকে নিয়ে বসায় রাস্তার ওপারে বাহন কাউন্টারের পাশে ফুটপাতের ওপর। ওখানেই শুরু হয় বাবার নতুন আখড়া।
তবে এতে খুশি হতে পারেনি নাসির-নান্টু গংরা। তারা উত্তর শাহজাহানপুর লেকপাড়ের সরকারি জমিতে একটি খুপরি দখলে নেয়।
তার পরই নভেম্বরের ২৮ তারিখে সদলবলে হানা দেয় নূরে বাবার আখড়ায়। তারা দা, চাপাতি, ছুরি নিয়ে হামলা চালায় মুরিদদের ওপর। ভয়ে সাধারণ মুরিদরা সরে গেলে নূরে বাবাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসে ঝিলপাড়ের খুপরিতে। এখানেই শুরু হয় মাইজভান্ডারিদের পীর খানকায়ে শরিফের কার্যক্রম। এই নিয়ে সাধারণ মুরিদদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
তবে নাসির, নান্টু, সেলিম এবং জামালরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান এবং সন্ত্রাসীদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় কেউ তাদের কিছু বলতে পারছেন না।
মুরিদ রাজিয়া বানু জানিয়েছেন, ‘বাবা এখানে আসতে চাননি। আমাদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাবাকে ওরা তুলে নিয়ে এসেছে। বাবা এখান থেকে চলে যেতে চান, কিন্তু জোর করে তাকে এখানে এক প্রকার আটকে রাখা হয়েছে।’
কুমিল্লার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন অভিযোগ করেন, পীর এবং মাইজভান্ডারি এক নয়। এখানে গানবাজনাসহ অনেক অসামাজিক কার্যকলাপ চলে, যা বাবা পছন্দ করেন না। এটা ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ। কিন্তু পুলিশ এবং স্থানীয় একটি মাস্তান বাহিনী এই আখড়া পরিচালনাকারীদের সঙ্গে থাকায় কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, তিন কারণে ছিনতাই করা হয়েছে নূরে বাবাকে। এক, ঝিলপাড়ের সরকারি জমি দখল করা। দুই, বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ। তিন, মাদকের ব্যবসা পরিচালনা।
নাম প্রকাশ করা হবে না এই শর্তে কয়েকজন মুরিদ জানিয়েছেন, বাবার আখড়ায় প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকা সালামি ওঠে। এ ছাড়া অনেক মুরিদ মাঝেমধ্যে ৫০০ থেকে দুই-পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। এতে মাসে গড়ে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় হয়।
এই পুরো টাকা পকেটস্থ করে নাসির-সেলিমরা। এ জন্য তারা একটি খানকা পরিচালনা কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিতে নূরে বাবার কোনো মুরিদ না থাকায় টাকার হিসাব কেউ নিতে পারেন না।
সপ্তাহে দুই দিন যে তবারক বিতরণ হয়ে তাতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা চলে যায় এই গ্রুপের পকেটে।
এ ছাড়া গণপূর্তের এই জমিটি দখল করার মতলবও রয়েছে মাইজভান্ডারি গ্রুপটির। এ জন্য সুকৌশলে নূরে বাবাকে এনে আখড়া বানিয়ে ধর্মীয় অনুভূতি সৃষ্টি করেছে তারা। এর পাশেই যে বস্তি রয়েছে তারও নিয়ন্ত্রণ এই চক্রের হাতে।
এই আখড়ায় শুধু গানবাজনাই নয়, এখানে গভীর রাতে চলে গাঁজার আসর। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এখানে মাদক ব্যবসাসহ চলে নারী নিয়ে বেলেল্লাপনা।
ওসি দিয়েছেন সরকারি জমি!
এই আখড়ার জমিটি গণপূর্ত বিভাগের। তাতে কি? শাহজাহানপুর থানার ওসি মেহেদি হাসান বিশেষ ক্ষমতা বলে অলিখিতভাবেই আখড়া চালাতে জমিটি দান করেছেন নাসির-নান্টুদের। এমন কথাই স্থানীয় মুরব্বিদের বলে বেড়াচ্ছেন তারা। থানার ওসি জমি দান করায় এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে সাহস পাচ্ছেন না কেউই। পুলিশের অনেক এসআই, এএসআই এই আখড়ায় যাওয়া-আসা করেন। অনেকেই বলেছেন, এখান থেকে পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ পায়।
রাতে পাগলা মামার আশীর্বাদের অপেক্ষায় ভক্তরা
শুধু জমি নয়, পুলিশের অনুমতি নিয়ে আখড়ার সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ আনসারের একটি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দখলে নিয়েছে এরা। এখানেই রাতে চলে মাইজভান্ডারি গান এবং আড্ডা।
ওসি মেহেদি হাসান বিষয়টি একদমই জানেন না বলে জানিয়েছেন । কিন্তু নূরে বাবা দরবার পরিচালনা কমিটির সভাপতি নাসির উদ্দিন জোর দিয়ে বলেছেন, ওসি মেহেদি হাসানের মৌখিক অনুমতি নিয়েই গণপূর্তের এই জমিতে দরবার বসানো হয়েছে।
নাসির জানান, মৌচাক মার্কেট পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ফরচুন গ্রুপের পরিচালক হাজি আবুল এখানে ঘর তৈরিতে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তার তত্ত্বাবধানেই এখানে মামার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গণপূর্ত এই জমিতে শিশুপার্ক, বাগান এবং কবরস্থান তৈরি করার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ওই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে লেকের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজের মধ্যেই প্রায় ৫ কাঠা জমি দখলে নিয়ে নূরে বাবা দরবার বসিয়েছে মাজভান্ডারি গ্রুপটি। সরকারি জমি দখল করাই এদের উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে নাসির উদ্দিন বলেছেন, জমিতে শুধু নূরে মামাকে থাকার জন্য স্থান দেওয়া হয়েছে, দখল করার উদ্দেশ্য তাদের নেই। এ ছাড়া নূরে মামাকে অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করা হয়নি বলেও জানান তিনি। গুলবাগ রেলগেটে খোলা আকাশে নিচে না রেখে মামাকে এখানে আনা হয়েছে শুধু তার সেবা করার জন্য। কারণ, তিনি একজন মারজুক বা পাগল এবং বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় তার খেদমত করার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা। টাকা আত্মসাতের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
তবে স্থানীয়রা বলেছেন, যাই হোক, এই মারজুক আধ্যাত্মিক নূরে বাবাকে দিয়ে যে ব্যবসা চলছে তা মানতেই হবে। প্রভাবশালী থেকে চুনোপুঁটি অনেকেই এখান থেকে লাভবান হচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, এই দরবারের কারণে সরকারি এই জমিটুকু বেহাত হতে পারে। এ ছাড়া বাগান ও শিশুপার্ক করার যে পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের, তাও বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।