ডাক্তার হলে মানুষ হতাম, লেখক বলে অমানুষ!
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৭:৩৮,অপরাহ্ন ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪
রুমানা বৈশাখী::
বাংলাদেশে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। আর সেটা হলো, মা-বাবা সবসময় ঠিক, সন্তান সবসময় ভুল। মা-বাবা খুনী, গুন্ডা, বদমাইশ, চরিত্রহীন ইত্যাদি যাই হোক না কেন তারা ঠিক। আর ছেলেপেলের চুল পেকে বুড়ো হয়ে গেলেও তারা ভুল। বেশিরভাগ মানুষ এই বিষয়টা “আমাদের সংস্কৃতি” বলে গর্ব করার চেষ্টা করলেও এটা নিয়ে আসলে গর্ব করার কিছু নেই। বরং এটা খারাপ।
আমাদের সমাজে পিতামাতার সাথে সন্তানের স্বচ্ছ ও সুন্দর সম্পর্কের চর্চা নেই। ছেলেবেলায় সন্তান হচ্ছে দুটো চড় মেরে সোজা রাখার জিনিস, বড় হবার পর হচ্ছে বুড়ো কালের বিনিয়োগ। হয়তো সবার নয়, কিন্তু এই দেশের বেশিরভাগ সন্তানের জীবন কেটে যায় মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে করতে। সন্তান কী চায়, সেটা জিজ্ঞেস করার মত মানসিকতা কারো নেই। মা বাবার স্বপ্ন ও সন্তানের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটিয়ে যে একটা সুন্দর জীবন গড়ে তোলা সম্ভব, সেই বিষয়টির চর্চা কারো মাঝে নেই।
ছোটবেলায় মা বাবা শিখিয়ে দিতেন, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বড় হয়ে কী হবা, তাইলে বলবা- “ডাক্তার হবো”। মেয়েদের জন্য ডাক্তারি নিরাপদ পেশা, একান্তই ডাক্তার হতে না পারলে টিচার কিংবা সরকারী চাকুরে। আর ছেলেদের এক নম্বর পেশা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। টাকার কুমির হওয়ার একটা সুযোগ থাকবে, মাবাবা আর বউ সকলকে খুশি করতে করতেই কেটে যাবে বেচারার জীবন। অবশ্য যে সমাজে এখনো মানুষকে ধরে অপরিচিত একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় পাত্র পাত্রী পরস্পরকে পছন্দ না করলেও, আর বলে দেয়া হয় যে আজ থেকে এর সাথেই তুমি জীবন আর শরীর বিনিময় করবে, সে সমাজ থেকে আর কী আশা করা যায়? আধুনিকতার খোলসে মধ্যযুগীয় একটা সমাজ ব্যবস্থা আমাদের।
ছোটবেলা থেকেই আমরা অন্যকে খুশি করার মেশিন। আগের জেনারেশনগুলোর চাইতে আমাদের এবং পরবর্তী জেনারেশনগুলোতে এই বিষয় আরও প্রবল। সেদিনই একজন মায়ের সাথে দেখা হলো, যিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৮ বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে কোন টিভি অনুষ্ঠানে দেয়ার। গান শেখাচ্ছেন, নাচ শেখাচ্ছেন, অভিনয় শেখাচ্ছেন, ছবি আঁকা শেখাচ্ছেন। যত্ন করে চুল বড় করছেন, সারাক্ষণ সাজিয়ে গুজিয়ে রাখছেন। মেয়েটা আর মেয়ে নেই, একটা বারবি ডল হয়ে গেছে। তার সারাটা দিন কেটে যাচ্ছে এইসব শিখতে শিখতে। স্কুল থেকে ফিরে ক্লান্ত বাচ্চা মেয়েটি যেতে চাইছে না নাচের স্কুলে, নাচ তার ভালো লাগে না। মা চড় মেরে নিয়ে যাচ্ছেন… আমার নিজের চোখে দেখা পুরো বিষয়টি! আমি সেই মাকে বললাম, কেন এমন করছ তুমি? সে জবাব দিল, তার অনেক শখ মেয়েকে স্টার বানাবে। ও দীঘি বা পড়শির মত। এখন থেকে চেষ্টা না করলে হবে নাকি?
আমার মুখে কথা সরে না, মোটামুটি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমাদের চাইতেও এই শিশুগুলোর অবস্থা করুন। এদের পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা হবে আরও করুন। আমি না হয় জেদ করে ডাক্তার হওয়াকে পাশ কাটিয়ে গেছি, এই শিশুগুলো পারবে না। এদের জীবন কেটে যাবে অন্যের চাপিয়ে দেয়া বোঝার ঘানি টানতে টানতে…
পুনশ্চ-আমি কিন্তু ডাক্তার হইনি। লেখক হয়েছি। আর এটা নিয়ে আমার পিতাপাতার দুঃখের সীমা নেই। প্রায়ই আফসোস করে তারা বলেন, সন্তান মানুষ হলো না, এই কষ্ট তারা কোথায় রাখবেন। ডাক্তার হলে “মানুষ” হওয়া হতো, লেখক বলে অমানুষ! লেখক হয়েছি, কেমিস্ট হয়েছি, রন্ধন শিল্পী হয়েছি, ছোটখাট সমাজ সেবক হয়েছি, ব্যবসায়ী হয়েছি। কিন্তু তাতে কি? ডাক্তার তো হইনি!
আহারে, ডাক্তার ছেলেমেয়েদের মা-বাবার না জানি কত সুখ!!!!!