রানা প্লাজা ধসের ২ বছর : রানাকে বাঁচাতেই যত ঢিলেমি!
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৪১:৩৯,অপরাহ্ন ১৫ এপ্রিল ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
‘বস, বিল্ডিং ধসছে কি আমার দোষে? পাবলিকে আমারে তো খাইয়া ফালাইবো। বাঁচান বস।’ সাভারের রানা প্লাজা ধসের পরপর ভবনের মালিক সোহেল রানা তার ‘রাজনৈতিক গুরু’ মুরাদ জংয়ের সঙ্গে প্রথম কথোপকথনে এভাবেই আকুতি জানান।
রানার কাছের একজন, যিনি ওই সময় তার সঙ্গে ছিলেন তিনিই জানান এ ফোনালাপের কথা। দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘রানায় প্রথমে বোঝে নাই কী ক্ষতিডা হইসে। পরে যখন টের পাইসে তখন ভয় পাইসিলো পাবলিকরে। মামলার ভয় সে পায় নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘রানা ভাই ভাবসিলেন কিছুদিনের জন্য জেলে যাইতে হইলেও বস তারে বাইর কইরা আনবে কোনও এক কায়দায়।’
তবে, রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বের করে আনতে না পারলেও প্রথম একবছর নানা পরিকল্পনা করে রানার ‘ভাল থাকা’র ব্যবস্থা করে দেন মুরাদ। তার প্রভাবেই গত দুবছর ধরে বিচার শুরু করা যায়নি রানার বিরুদ্ধে। শুরুতে তৎকালীন সাংসদ তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ পুরোদমে রানাকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করলে পরে অবশ্য তিনি নিজেই ফেঁসে যান।
দুদকের মামলায় খোড়া যুক্তি দিয়ে রানাকে ছাড়াই প্রথমে প্রতিবেদন দাখিলের চেষ্টা করা হয়। পরে সমালোচনার মুখে নাম ঢোকে রানার। আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণে রাখা না হলে এতদিন রানা জেলের বাইরে থাকতো। ইতোমধ্যে একটি মামলায় হাইকোর্ট রানাকে জামিন দিলেও পরে তার জামিন আদেশ স্থগিত করা হয়। সব মিলিয়ে কারাগারের ভেতরে থেকেও দুই বছরে বহুবার রানাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে তার সহযোগীরা।
বিচারিক আদালত গতবছর সেপ্টেম্বরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ নির্ধারণ করে ৬ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। পরে ৬ নভেম্বর রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা পৃথক দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য দিন ধার্য থাকলেও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এরপর ২৪ ডিসেম্বর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দিতে পারেনি সিআইডি। বরং আরও সময় আবেদন জানালে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কাজী শহিদুল ইসলাম ১ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ দেন। এরপর আবার এপ্রিল এবং সবশেষ আগামী মে মাসের শেষে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সমাজকর্মী ও নৃবিজ্ঞানী নাজনীন শিফা বলেন, আমরা যখন শ্রমিকদের পক্ষে তাজরীনের মামলা তদারকির দায়িত্ব নিই, তখন দেখেছি কিভাবে তারিখের পর তারিখ পড়ে কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয় না। আবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে মামলা খারিজের আবেদন জানানোর মতো ঘটনাও ঘটতে দেখেছি। এ ধরনের অন্যায় শ্রমিকদের সাথে অনায়াসে করা সম্ভব হয়, কারণ ধরে নেওয়া হয় শ্রমিকরা ক্ষমতাহীন। তিনি বলেন, অনিয়ম করে রানাকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা করা হলে সেটা কেউই মেনে নেবে না।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে মুরাদ জংয়ের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হিসেবে রানার পরিচিতি সাভারের সব মহলেই ছিল। মুরাদ জংয়ের ছত্রছায়ায় নিজের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তার করেছেন রানা। আর রানা প্লাজা ধসের পর মুরাদের কর্মকাণ্ড জনসম্মুখে আসলে ভীষণভাবে সমালোচিত হয়ে প্রথমে রানাকে চিনতে অস্বীকার করেন মুরাদ। কিন্তু পরে এই রানাকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা, জেলখানায় ভাল ব্যবস্থাপনায় রাখা, রানার মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেওয়ার মতো কাজগুলোর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন ঠিকই। এটা প্রমাণিত হয় যখন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ মনোনয়ন চেয়েও পাননি। তার জায়গায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল রানা প্লাজার ধসে আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মালিক ডা. এনামুর রহমানকে।
সাভার আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা বলেন মুরাদ জংয়ের পক্ষে হরতালবিরোধী মিছিল ও সমাবেশ রানার তদারকিতেই হতো। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাভারের নানা জায়গায় স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ নানা আয়োজনে সোহেল রানা নামে সব পোস্টারেই মুরাদের ছবি বড় করে দেওয়া থাকতো। অনেকে মনে করেন, রানার মাথা থেকে মুরাদ জংয়ের হাত সরে যাওয়ার পর থেকেই মামলার অগ্রগতি দেখা গেছে। যদিও চার্জশিট দিতে আরও কতদিন লাগবে তা নিয়ে সংশয় আছে আন্দোলনকারীরা।
গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এইসব লোকেরা টিকে থাকে বলে শ্রমিক হত্যার বিচার আমরা পাই না। তাজরীনের শ্রমিক হত্যার বিচার হয়নি, মালিক দেলোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের তদন্তে দুই বছর কেন লাগবে এটাই তো জরুরি প্রশ্ন। চোখের সামনে ঘটা এতবড় হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি এখনও শুরু করা না যায় তাহলে এর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, শাস্তির দাবি টিকিয়ে রাখা জরুরি।
তদন্ত প্রশ্নে কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণ কর বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের নাম অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই চার্জশিট হবে। সূত্র জানিয়েছে, রানা প্লাজার মালিক থেকে শুরু করে ভবনের অন্যান্য গার্মেন্ট কারখানার মালিক এবং সাভার পৌরসভা, কারখানা পরিদর্শন বিভাগ এবং নির্মাণ কর্মকর্তারা এই ধসের জন্য দায়ী। কারণ ভবনে ফাটল আছে জানার পরও তারা শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন। সরকারি বেশকিছু কর্মকর্তার নাম সম্পৃক্ততা পাওয়া যাওয়ায় তাদের সবার নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করার অনুমোদন মেলেনি বলে চার্জশিট আটকে আছে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ২১ জনের মধ্যে ৮ জন জামিনে আছেন। তাদের কেউ দেশ ছেড়েছেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তর দেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
দুদক সূত্রে জানা যায়, নিয়মবহির্ভূতভাবে রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে ২০০৭ সালে স্থানীয় পৌরসভার মেয়রের কাছ থেকে ছয়তলা ভবনের অনুমতি নিলেও সরকারি দলের নেতা হওয়ার সুবাদে ক্ষমতার দাপটে তিনি সেটা ১০ তলা করেন। ২০০৭ সালের আগে ভবন নির্মাণের জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত, পেছনে ছিল জলাশয়। ভবন নির্মাণের জন্য এসবই দখল করে বালু ফেলে ভরাট করা হয়।
সূত্র : ট্রিবিউন।